প্রেস বিজ্ঞপ্তি | PDF
তারিখ: ১৭/০২/২০২৪

‘কর্মজীবী নারী’ প্রাতিষ্ঠানিক ও অ-প্রাতিষ্ঠানিক উভয় খাতের নারীশ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক জীবনমান ও শ্রমঅধিকার পরিস্থিতি জানার জন্য বিভিন্ন ধরনের গবেষণা ও জরিপ পরিচালনা করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি কর্মজীবী নারী ‘অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ’ এর সহযোগিতায় Transforming Care Work for Women in Ready-Made Garment Sector শিরোনামে মিরপুরে অবস্থিত চারটি তৈরি পোশাক শিল্পের ১০০ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে একটি র‌্যাপিড কেয়ার এ্যানালাইসিস পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে নারী’র অবৈতনিক সেবামূলক কার্যক্রমের একটি চিত্র তুলে আনা হয় এবং এর ফলে কর্মক্ষেত্রে তারা কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় সে বিষয়গুলোও সনাক্ত করা হয়।

নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তৈরি পোশাক শিল্পের নারীশ্রমিকের ক্রমহ্রাসমান পরিস্থিতি উন্নয়নে এবং তৈরি পোশাক খাতের নারীশ্রমিকদের বাধাসমূহ দূরীকরণে কারখানা ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরে আলোচনা করা সহ এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নে্য়ার লক্ষ্যে ‘কর্মজীবী নারী’ “পোশাক শিল্পের নারীশ্রমিকের গৃহস্থালি ও যত্ন/সেবামূলক কাজের (Domestic and Care Work) দায়িত্ব, প্রভাব ও করণীয়” শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে। এই মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেছেন শাহীন আক্তার, সহসভাপতি, কর্মজীবী নারী। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন সানজিদা সুলতানা, অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, কর্মজীবী নারী। সভায় উপস্থিত ছিলেন মেহজাবিন আহমেদ, হেড অব জেন্ডার জাস্টিস এন্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন প্রোগ্রাম, অক্সফ্যাম, ফতেমা তুজ জোহরা, প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপ ব্রোকার, অক্সফ্যাম। এছাড়াও উক্ত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কারখানার কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন, আইএনজিও, একাডেমিশিয়ান, নারী সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ববৃন্দসহ বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত নারী ও পুরুষ শ্রমিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

মতবিনিমিয় সভায় র‌্যাপিড কেয়ার এনালাইসিসের ফলাফল উপস্থাপন করেন রিনা আমেনা, প্রকল্প সমন্বয়ক, কর্মজীবী নারী। র‌্যাপিড কেয়ার এনালাইসিসের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা গেছে, তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত নারীশ্রমিকেরা প্রতিদিন ৪.৫৭ ঘন্টা সময় গৃহস্থালি ও যত্ন/সেবামূলক কাজে ব্যয় করে যেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক ব্যয় করে ১.৮৩ ঘন্টা। দেখা যাচ্ছে নারীরা এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে ২.৭৪ ঘন্টা বেশি সময় ব্যয় করে। অন্যদিকে দেখা যায়, একজন পুরুষ নিজের জন্য সময় ব্যয় করে প্রতিদিন গড়ে ১২.৬৯ ঘন্টা যেখানে একজন নারী নিজের জন্য সময় পায় গড়ে মাত্র ৯.২০ ঘন্টা। এখানে দেখা যায়, নারীরা গড়ে প্রতিদিন নিজের জন্য পুরুষের তুলনায় ৩.৪৯ ঘন্টা কম সময় ব্যয় করে। এ থেকেই বোঝা যায়, গৃহকর্ম এবং সেবামূলক কাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারসাম্যহীনতা রয়েছে যা নারীর ভালো থাকা ও নিজের প্রতি যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যার ফলে নারী কর্মক্ষেত্রে অনেক বাধার সম্মুখীন হন যা পোশাক শিল্প হতে নারীকে সরে আসতে বাধ্য করে।

নারীশ্রমিক কাজলরেখা বলেন, আমাদের সন্তানদের দেখাশোনা করাটাই চাকরি ছেড়ে দেয়ার প্রধান কারণ্, এছাড়া সন্তানকে নিরাপদে স্কুলে আনা-নেয়া ও দেখাশোনা করার কেউ থাকে না্। ফলে বাধ্য হয়েই নারীদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এক্ষেত্রে যদি নারীশ্রমিকদের সহযোগিতা করা হয় তাহলে তারা ঝরে পড়বে না।

ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কামরুন নাহার, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন বলেন, নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রধান্য দেয়া হয় না। সে ঘরে বাইরে অনেক কাজের চাপে থাকে। ফলে একসময় ঘর সামলানো আর চাকরি সামলানোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে তারা কাজ ছেড়ে দেয়। তাই নারীর মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের যথাযথ মূল্যয়ন করতে হবে। তাহলেই কর্মক্ষেত্র থেকে নারী আর ঝরে পড়বে না।

ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এম এ সালাম, গার্মেন্ট শ্রমিক জোট বাংলাদেশ বলেন, স্থানীয় সরকারি জনপ্রতিনিধি, কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং সুশাীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কমিউনিটি ডে কেয়ার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ডে কেয়ারে বাচ্চা রাখার সময় বাড়াতে হবে। তাইলে নারীরা দুশ্চিন্তামুক্তভাবে কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে।

কারখানা ব্যবস্থাপক প্রতিনিধি বলেন, ডে-কেয়ার বিষয়ে শ্রম আহনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। কেবলমাত্র বায়ারকে দেখানোর জন্য ডে-কেয়ার স্থাপন করলে হবে না, বরং একজন শিশুকে সঠিকভাবে লালন পলন করার জন্য সকল সুযোগ সুবিধা প্রদানসহ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিচর্যাকারী নিয়োগ করে ডে কেয়ার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এছাড়া কারখানার প্রতিনিধিরা পিতৃত্বকালীন ছুটি প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন।

এছাড়া শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ৬মাস মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ ৬-১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার দাবিও করেছেন। নারীশ্রমিকেরা বলেন, আমরা চাই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হোক এবং আমাদের কাজের মূল্যায়ন করা হোক। আমরা নিরাপদ কর্মপরিবেশ চাই যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য থাকবে না। আমরা চাই কারখানায় যেন একজন বাচ্চাকে রাখার মত সকল সুযোগ সুবিধা থাকে।

ফাতেমা তুজ জোহরা, প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপ ব্রোকার, অক্সফ্যাম বলেন, ফ্যাক্টরির উন্নয়নের জন্যই নারীদের অবৈতনিক পরিচর্যার চাপ কমাতে হবে। কারণ ব্যবসা করতে হলে মানবাধিকারকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। ফলে নারীকে ঘরে-বাইরে কাজের ক্ষেত্রে এমন কোন চাপে ফেলা যাবে না যা তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আজকের এই সভা থেকে আমরা এমন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে আসবে যা দিয়ে আমরা গঠনমূলক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।

মেহজাবিন আহমেদ, হেড অব জেন্ডার জাস্টিস এন্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন প্রোগ্রাম, অক্সফ্যাম বলেন, সবার আগে সামাজিক ও পারিবারিক পরিবর্তন আনতে হবে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর নারীর কাজের চাপ বেড়ে গেছে। নারী শ্রমিকের পক্ষে যে আইনগুলো আছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। নারীর অবৈতনিক কাজের স্বীকৃতি নিয়ে অক্সফাম এবং কর্মজীবী নারী একত্রে কাজ করছে।

সভায় বক্তারা আরও বলেন, কারখানায় সরকারের নজরদারি আরও শক্তিশালী করতে হবে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত পরিদর্শন প্রয়োজন। এছাড়াও শ্রমিকের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য রেশন এবং চাকুরি শেষে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

মতবিনিময় সভার সভাপতি শাহীন আক্তার, সহসভাপতি, কর্মজীবী নারী বলেন, আমরা চাই গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করা হোক। যেখানে শিশুদের জন্য ডে কেয়ার এবং বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল সুযোগ-সুবিধা থাকবে। তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভা শেষ করেন। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন সানজিদা সুলতানা, অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক, কর্মজীবী নারী।

Pin It on Pinterest